সফটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন বিজনেস সফটওয়্যার এলায়েন্স (বিএসএ) সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে কম্পিউটারগুলোতে যত সফটওয়্যার ইন্সটল করা হয়েছে, তার শতকরা ৮৬ ভাগ ছিল পাইরেটেড। শতকরার এই হিসাবে বাংলাদেশ সফটওয়্যার পাইরেসির ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ। শতকরা ৯০ ভাগ পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার করে যৌথভাবে প্রথম স্থানে রয়েছে লিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে দেশটিতে পাইরেটেড সফটওয়ার ব্যবহারের হার ছিল ৯১ শতাংশ, ২০১১ সালে ৯০ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৭ শতাংশ। শতকরার হারে বছর বছর পাইরেটেড সফটওয়ার ব্যবহারের হার কমেছে ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ায় পরিমাণ বেড়েছে আগের চাইতে অনেক বেশি। পরিস্থিতি এখন এমন, অনেক ব্যবহারকারী জানেনই না যে সফটওয়্যার আলাদাভাবে কিনে ব্যবহার করবার একটি জিনিস। যেমনটি জানেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী (তার নামটি প্রকাশ করা হলো না), যিনি বেশ কয়েক বছর ধরেই বাড়িতে নিজের একটি কম্পিউটার ব্যবহার করছেন।
পাইরেটদের সন্ধানে
বাংলাদেশে কম্পিউটার কেনা-বেচার সুপরিচিত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মার্কেট ঢাকার বিসিএস কম্পিউটার সিটি, যেটি অনেকের কাছে ‘আইডিবি ভবন’ বলেও পরিচিত। এক সন্ধেবেলায় সেখানে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম মার্কেটটি। এখানে কম্পিউটারের নানারকম ব্র্যান্ড শপ, নানা হার্ডওয়্যার ও হরেক রকম অ্যাকসেসরিজের পাশাপাশি রয়েছে সফটওয়্যার বিক্রির কয়েকটি দোকানও। একটি দোকানে গিয়ে দেখতে পাই থরে থরে সাজানো সিডি ও ডিভিডি কোনটিতে ভিডিও গেম। কোনটিতে অ্যান্টি-ভাইরাস। কোনটিতে টিউটোরিয়াল। আবার কোনটিতে সফটওয়্যার।
দোকানি অবলিলায় স্বীকার করেন, এখানে সফটওয়্যারের যত সিডি আছে, তার সবই পাইরেটেড। যদিও সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। ছবি তুলতেও বাধা দেন এই দোকানি। আরেক দোকানে গিয়েও সংবাদদাতা একই পরিস্থিতির মুখে পড়েন। তবে এখানে কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে পাইরেটেড সফটওয়্যার। কোনো লুকোছাপা নেই। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন হার্ডওয়ার ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন সরবরাহকারীরা ব্যাগে করে পাইরেটেড সফটওয়্যার নিয়ে এসে পাইকারি দরে দোকানিদের দিয়ে যায়। একটি সিডির জন্য তারা দাম নেয় ৩০ টাকা। আর দোকানে পরে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে প্রতিটি সিডি।
শতকরার হারে বছর বছর পাইরেটেড সফটওয়ার ব্যবহারের হার কমেছে ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ায় পরিমাণ বেড়েছে আগের চাইতে অনেক বেশি।
যতদূর জানা যাচ্ছে, পাটুয়াটুলি এবং গুলিস্তান থেকে এসব পাইরেটেড সফটওয়্যার পাইকারি দরে সংগ্রহ করে তারা। অবশ্য এসব স্থানে গিয়ে পাইকারি দরে পাইরেটেড সফটওয়্যার বেচার কোনো দোকান চোখে পড়ল না। ফলে পাইরেটেড সফটওয়্যারের সূত্র খুঁজতে গিয়ে এখানেই আটকে যেতে হলো। একসময় পাকিস্তান ও দুবাই থেকে পাইরেটেড সফটওয়্যারের মাস্টার কপি ঢাকায় এনে শত শত কপি করে ছড়িয়ে দেওয়া হত। তবে আজকাল সিডি-ডিভিডির চাহিদা কমে যাওয়ায় ইন্টারনেটে টরেন্ট আকারে পাওয়া যায় পাইরেটেড সফটওয়্যার। আর ইন্টারনেট ও সিডি রাইটারসহ একটি কম্পিউটার হলে যেকোনো জায়গায় বসেই তৈরি করে ফেলা সম্ভব পাইরেটেড সফটওয়্যারের সিডি। সফটওয়্যার আবার বেচার জিনিস নাকি? মোস্তফা জব্বার বাংলাদেশের একজন প্রথম প্রজন্মের তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এখন তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি। তিনি বাংলা লেখার সফটওয়্যার বিজয় তৈরি করে ১৯৮৮ সালে কপিরাইট করেছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে সফটওয়্যারটির বিপণন শুরু করেন, তখন অনেক মানুষই তাকে গালমন্দ করেছে বলে জানান মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ৯৩ সালে প্রথম মার্কেটিং করতে গেলাম, প্রচুর গালিগালাজ শুনেছি। এখনও শুনি। সফটওয়্যার বিক্রি করছি কেন?’
‘তখন রীতিমত এটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল, সফটওয়্যার কি আবার বিক্রি করা যায় না কি?’, বলেন মোস্তফা জব্বার। কিন্তু বাংলাদেশে এই ধারণাটা কীভাবে শেকড় গাড়ল, পাইরেসিই বা কিভাবে মহীরুহ ছড়াল? জানতে চাইলে প্রথম প্রজন্মের এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘প্রথম দিকে মনে করা হয়েছে, বাংলাদেশে পাইরেসি তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশে সহায়তা করবে’।
‘কারণটা হলো, আমার দেশের মানুষের কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার কেনার সক্ষমতাও দেখিনা, যদি সফটওয়্যার কেনার মতো অবস্থায় যায়, তাহলে সেটা দাম টাম মিলিয়ে অনেক হয়ে যেতে পারে। সেই সময়ে এক ধরনের সফট কর্নার এমনকি আমাদেরও ছিল। এমনকি দোকানদারেরা পর্যন্ত নিজেরা পাইরেসি করে যারা ব্যবহারকারী তাদের উৎসাহিত করেছে, কম্পিউটারটা ব্যবহার করতে’, যোগ করেন তিনি।
কিন্তু আজ এতদিন পরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নিজেরাই সফটওয়্যার তৈরি করছে, সরকারের অগ্রাধিকারে যখন সফটওয়্যার প্রস্তুত খাত গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের কম্পিউটার বিক্রেতারা দেখা যাচ্ছে, এখনও ক্রেতাদের পাইরেটেড সফটওয়্যার নিতে উৎসাহিত করছে।
কম্পিউটার বিক্রির বেশিরভাগ দোকানে গেলেই ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন মূল্য তালিকা। এতে সফটওয়্যারের মূল্যের কোনো উল্লেখ্য নেই। বলা হচ্ছে, হার্ডওয়্যার কিনলেই সফটওয়্যার দেওয়া হবে ফ্রি।
পাইরেসির মহোৎসব
বিসিএস কম্পিউটার সিটির বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শুরুতেই ক্রেতাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন রকমের কম্পিউটারের প্যাকেজ মূল্য তালিকা। এসব মূল্য তালিকায় সফটওয়্যারের দাম উল্লেখ নেই। নামকরা এবং জনপ্রিয় একটি কম্পিউটার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়-কর্মী সংবাদদাতাকে ক্রেতা মনে করে বলেন, ‘বাড়িতে ব্যবহার করার জন্য কম্পিউটারে লাইসেন্স করা সফটওয়্যার প্রয়োজন নেই। পাইরেটেডই যথেষ্ট’। বলা চলে, বলে কয়ে পাইরেসির একেবারে মহোৎসব চলছে বাংলাদেশের কম্পিউটার ব্যবসায়।
এমনকি পাইরেটেড সফটওয়্যার বেচতে গিয়ে কোনোসময় কোনো বাধার মুখেও পড়েননি বলে জানালেন এক বিক্রেতা। অথচ পাইরেসি ঠেকাতে আইন রয়েছে বাংলাদেশে। তবে এসব আইনের খুব যে প্রয়োগ নেই, তা বোঝাই যাচ্ছে। ঢাকায় পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান অবশ্য বলছেন, অভিযোগ পেলে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।
কম্পিউটারের দাম হবে লাখ লাখ টাকা!
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, সফটওয়্যার পাইরেসি বন্ধ করার চেষ্টা করা হলে, বাংলাদেশের মানুষ কম্পিউটার কেনা বন্ধ করে দেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘একটা কম্পিউটারে ব্যাবহারযোগ্য সফটওয়্যারগুলিই যদি টাকা দিয়ে কিনতে হয়ে তাহলে সেই কম্পিউটারের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এত টাকা দিয়ে কেউ কিনবে নাকি?’


